মাহবুর রহমান কাশেম
কুমিল্লার রসমালাই। নাম শুনলেই জিভে পানি আসে। ঐতিহ্যবাহী এ মিষ্টান্নের খ্যাতি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখন বহির্বিশ্বেও ছড়িয়েছে। কুমিল্লায় গেছেন, কিন্তু রসমালাই চোখে দেখেননি এবং এর স্বাদ গ্রহণ করেননি এমন মানুষ পাওয়া মুশকিল। দেশের বিভিন্ন স্থানে রসমালাই তৈরি হলেও কুমিল্লার রসমালাই স্বাদে অতুলনীয়। দীর্ঘ ১০০ বছর ধরে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে আছে এ মিষ্টান্ন।
প্রতিদিন প্রচণ্ড ভিড় লেগেই থাকে মনোহরপুর এলাকায় অবস্থিত মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই দোকানে। বিশেষ করে বৃহস্পতিবার, শুক্রবার ও শনিবারে সবচেয়ে বেশি ভিড় লেগে থাকে। কেননা এ তিন দিনে বিয়ে ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আত্মীয়দের বাসায় রসমালাই নিয়ে যান মানুষজন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায় , ১৯ শতকের প্রথমদিকে ঘোষ সম্প্রদায় দুধ ঘন করে ক্ষীর বানিয়ে তাতে ছোট আকারের শুকনো ভোগ বা রসগোল্লা ভিজিয়ে যে মিষ্টান্ন তৈরি করতো তা ক্ষীরভোগ নামে পরিচিতি পায়। পরে এ মিষ্টান্ন রসমালাই নামে পরিচিতি লাভ করে। খানিন্দ্র সেন ও মনিন্দ্র সেন নামের দুই ভাই রসমালাই বিক্রি শুরু করলে, অতি অল্প সময়ে রসমালাইয়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। মাত্র ৩০০ টাকা কেজি হলেও কুমিল্লায় আসা বিভিন্ন জেলার মানুষ ও পর্যটকরা রসমালাই না খেয়ে বা সঙ্গে না নিয়ে যাবেন, তা হতেই পারে না। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৭টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত চলে বেচা-কেনা। স্থানীয়রা ছাড়াও দূরদূরান্ত থেকে কুমিল্লায় বেড়াতে আসা লোকজন রসমালাই কিনতে ভুল করেন না। বাংলাদেশে আগত বিদেশি মেহমান আপ্যায়নের মেন্যুতেও থাকে কুমিল্লার রসমালাই। রাষ্ট্রীয় সফরে আসা অতিথিদের সম্মানে আয়োজিত ভোজেও রাখা হয় রসমালাই। প্রতিদিন শত শত লোক লাইনে দাঁড়িয়ে রসমালাই ক্রয় করে থাকেন। কুমিল্লায় বছরে প্রায় ৫০ হাজার মন রসমালাই তৈরি হয়, যার বাজার মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা।
কুমিল্লার রসমালাইয়ের নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান মাতৃভাণ্ডার-এর সুনামকে পুঁজি করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড থেকে শুরু করে দাউদকান্দি পর্যন্ত অসংখ্য নকল মাতৃভাণ্ডার গড়ে উঠেছে। এসব নকল মাতৃভাণ্ডারের কারণে কুমিল্লা নগরের মনোহরপুরের আসল মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই তার সুনাম হারাচ্ছে। এ সব নকল রসমালাইয়ের দোকানগুলোকে আইনের আওতায় আনা উচিত বলে মনে করেন ক্রেতারা।
এ বিষয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে যোগাযোগ করলে কর্তৃপক্ষ জানান, মাতৃভাণ্ডার নামে তারা কাউকে লাইসেন্স দেয়নি। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের স্যানিটারি ইন্সপেক্টর (ফুড অ্যান্ড স্যানিটারি) মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দীন ভূঁঞা জানান, আসল মাতৃভাণ্ডার কর্তৃপক্ষ যদি লিখিতভাবে অভিযোগ জানায়, তবে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারতাম।
কুমিল্লার রসমালাই বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য বা জিআই পণ্য হিসেবে ২০২৪ সালে অনুমোদন পেয়েছে।
এ বিষয়ে মাতৃভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী অনির্বাণ সেন গুপ্ত বলেন, “ব্রিটিশ আমলে ঘোষরা মিষ্টি তৈরি করতো। একটা সময় বর্ণের পার্থক্য কমে আসে। হিন্দুদের বিভিন্ন বর্ণ ও মুসলিমরাও মিষ্টি তৈরি শুরু করে। পার্থক্য কমে আসায় আমরাও বংশ পরম্পরায় এ ব্যবসা ধরে রাখি। মন্দিরের কালী মায়ের নামটি নিয়ে দোকানের নাম মাতৃভাণ্ডার করা হয়েছে।”
মনোহরপুর মাতৃভাণ্ডারের ব্যবস্থাপক অনুপদাস জানান, বর্তমানে আমাদের দোকানের অনেক পুরোনো কারিগর উত্তম দে ও ক্ষিতিষ মোদক নামের দু’জন থেকে রসমালাই বানানোর কৌশল শিখেছেন। একটি কড়াইয়ে ৪০ মণ দুধ গরম করে ১৪ থেকে ১৫ কেজি ক্ষীর করা হয়। এ ক্ষীরের সঙ্গে কিছু ময়দা ও ছানা দিয়ে রসমালাই করা হয়। কুমিল্লার প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, কুমিল্লার রসমালাই স্বাধীনতার পূর্বে ক্ষীরভোগ নামে পরিচিত ছিল। স্বাধীনতার পর রসে ডুবা মিষ্টি ক্ষীরভোগ ক্রেতাদের মুখে মুখে হয়ে যায় রসমালাই। তাই মহনোহরপুরের এ রসমালাইয়ের স্বাদ অটুট রয়েছে। কমনওয়েলথের রাষ্ট্রদূতরা কুমিল্লায় এলে তারা এ রামালাইয়ের স্বাদ নিয়ে থাকেন।
এ বিষয়ে নগর ইতিহাসবিদ ও ইতিহাস গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, কুমিল্লায় মনীন্দ্র সেন ও ফনীন্দ্র সেন প্রথম রসমালাইয়ের ব্যবসা শুরু করেন। যদিও প্রথমে এ মিষ্টান্নের নাম ছিল ক্ষীরভোগ। তখন কুমিল্লা ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের হেডকোয়ার্টার এবং বাণিজ্যকেন্দ্র। এখানে ব্রিটিশ কর্মকর্তা ও নগরীর উচ্চবিত্তের কাছে ক্ষীরভোগ বেশ জনপ্রিয়তা পায়। তারা কুমিল্লার বাইরে বেড়াতে গেলে ক্ষীরভোগ নিয়ে যেতেন। এর ফলে বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে রসমালাইয়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এই মিষ্টান্ন রসে পরিপূর্ণ বলে মানুষের মুখে মুখে এটি রসমালাই হয়ে যায়।
কুমিল্লার রসমালাই উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে – মাতৃভাণ্ডার, ভগবতী পেড়া ভাণ্ডার, শীতল ভাণ্ডার, কুমিল্লা মিষ্টি ভাণ্ডার, জলযোগ, পিপাসা, পোড়াবাড়ি ও জেনিসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
Leave a Reply