যুগ-যুগান্তর
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা। ফাইল ছবি
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীদের ভর্তির ক্ষেত্রে কোটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা আছে। চলতি বছরে আন্দোলনের পর কোটা সংস্কার হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে কোটা রয়েই গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় এখনো ছয় ধরনের কোটা রয়েছে। আলোচিত মুক্তিযোদ্ধা কোটায় তাদের নাতি-নাতনিদের সুযোগও রয়েছে। ‘অযৌক্তিক’ পোষ্য কোটাও আছে। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট ফোরামে বিতর্কও হয়েছে; সিদ্ধান্ত হয়েছে কমিটি গঠনের। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, কোটাব্যবস্থায় অনিয়মের সুযোগ রয়েছে। এটি বাতিল বা সংস্কার করা উচিত।
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য যে ছয় ধরনের কোটা রয়েছে, সেগুলো হলো ১. ওয়ার্ড বা পোষ্য কোটা, ২. উপজাতি বা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী কোটা, ৩. হরিজন ও দলিত সম্প্রদায় কোটা, ৪, প্রতিবন্ধী কোটা, ৫. মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনি কোটা এবং ৬. খেলোয়াড় কোটা। হিজড়া সম্প্রদায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে বিশেষ বিবেচনা পায়। মুক্তিযোদ্ধা কোটা সবচেয়ে বেশি ৫ শতাংশ; পোষ্য ও খেলোয়াড় কোটা নির্দিষ্ট করা নেই। বাকিগুলোয় ১ শতাংশ কোটা রয়েছে। উল্লেখ্য, কোটায় পাস করলেই ভর্তির সুযোগ।
স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিচালনা-সংক্রান্ত ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশে ভর্তির বিষয়ে কোটা-সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধার স্পষ্ট উল্লেখ নেই। তবে ভর্তির বিষয়ে কমিটিকে ক্ষমতা দিয়ে অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ভর্তি কার্যক্রম অধ্যাদেশের ৪৬ ধারা অনুযায়ী ভর্তি কমিটি দ্বারা নির্ধারিত কার্যপ্রণালি অনুসরণ করতে হবে। ধারণা করা হয়, এ ধারাকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়েই ভর্তি পরীক্ষায় কোটা পদ্ধতি চালু করা হয়।
সম্প্রতি ঢাবিতে ডিনস কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের আন্ডারগ্র্যাজুয়েট কোর্সের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই সুপারিশে আগের মতোই ছয় ধরনের কোটা বহাল রাখা হয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ভর্তি কমিটির সভায় মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে বিতর্ক হয়। কোনো কোনো সদস্য মুক্তিযোদ্ধা কোটা একবারে বাতিল অথবা শুধু সন্তানদের জন্য ১ শতাংশ কোটা রাখার পক্ষে মত দেন; তারা নাতি-নাতনিদের জন্য কোটা পুরোপুরি বাদ দিতে বলেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সভায়ও এ নিয়ে আলোচনা হবে। তবে সংস্কার হলেও এ বছর থেকেই পরিবর্তন হবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন ভর্তি কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কোটা রাখা না রাখার বিষয়ে ভর্তি কমিটির সভায় আলোচনা হয়েছে। বিভিন্নজন বিভিন্ন অভিমত দিয়েছেন। পরবর্তী অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সভায় বিস্তারিত আলোচনা হবে। এরপর এ কোটা থাকবে কী থাকবে না কিংবা চলতি বছরেই সংস্কার হবে কি না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। কমিটি হলে তারাও বিষয়টি দেখবে।’
সরকারি চাকরিতে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ কোটা ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিতেই ৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা রাখার বিষয়টি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষকই মুক্তিযোদ্ধা কোটা কমিয়ে আনা এবং মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিদের জন্য সুযোগ বন্ধের পক্ষে কথা বলেছেন। শিক্ষকদের একটি অংশ বলছেন, এ সময় নাতি-নাতনিদের কোটা কোনোভাবেই থাকতে পারে না। সর্বোচ্চ ১ শতাংশ রাখা যায় সন্তানদের জন্য। তবে শিক্ষকরা কেউ পোষ্য কোটার বিরোধিতা করেননি।
বিগত বছরগুলোয় বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পোষ্য কোটায় ভর্তির ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতির কথা উঠেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পোষ্য কোটায় ভর্তিবিষয়ক জটিলতা নিয়ে তুমুল সমালোচনা হয়েছিল। পোষ্য কোটায় সুবিধা পান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছেলেমেয়ে এবং স্বামী-স্ত্রী। অবসরে যাওয়ার এক বছর পরও এ সুযোগ পেয়ে থাকেন তারা। এ সুবিধার জন্য আবেদন করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির পরিচ্ছন্নতাকর্মী, মালী থেকে শুরু করে জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকরাও। এ ক্ষেত্রে ভর্তির নির্দিষ্ট কোনো আসনও নেই। পোষ্য কোটায় অনিয়মের সুযোগ থাকে এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারতন্ত্রের কবলে পড়েছে বলেও মনে করেন কেউ কেউ।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ২০২৪-এর জুলাই ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সব ক্ষেত্রে বৈষম্যমুক্ত সমাজব্যবস্থা তৈরি করা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বৈষম্যহীন ব্যবস্থা গঠনের দাবি ওঠে অথচ সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির প্রক্রিয়ায় বৈষম্য বিদ্যমান। আর নয় কোটা, এবার মেধাই হবে একমাত্র যোগ্যতা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী সাকিব হাসান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন যে পোষ্য কোটা রেখেছে, তার কোনো যৌক্তিকতা নেই। সংবিধানে কোটা শুধু পিছিয়ে পড়াদের জন্য রাখা হয়েছে। আইনের বদৌলতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় চাকরিরতদের সন্তানদের অনৈতিক সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, তার কোনো স্বচ্ছ ব্যাখ্যা নেই। এখন মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নাতি-নাতনিদের সুযোগ দেওয়া হবে লজ্জাজনক।’
ইউনিভার্সিটি রিফর্ম ইনিশিয়েটিভ (ইউআরআই) প্ল্যাটফর্মের মুখপাত্র আদনান মুস্তারি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সমাজে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কিছু সুযোগ-সুবিধা রাখতে হবে। তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুবিধাবঞ্চিত। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনি কোটা, পোষ্য কোটা এসবের কোনো দরকার আছে বলে মনে করি না। এসব কোটা বরং বৈষম্য বাড়ায়।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তির ক্ষেত্রে একটি আসনের বিপরীতে যখন অসংখ্য শিক্ষার্থীকে প্রতিযোগিতা করতে হয়, তখন শুধু পাস করেই কোটা দিয়ে অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে। এ বৈষম্যের সুযোগে মেধাবীদের বঞ্চিত করে গড়পড়তা শিক্ষার্থীরাও দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোয় ঢুকছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটাব্যবস্থার কোনটি সুফলদায়ী, কোনটি সুবিধাবাদী, কোনটি রাখা দরকার, কোনটি বাতিল হওয়া উচিত, কোনটির সংস্কার হওয়া উচিত সে বিষয়ে জনস্বার্থে নতুন নীতিনির্ধারণ হওয়া দরকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তারিক মনজুর বলেন, ‘বিভিন্ন ধরনের কোটা সুবিধার ক্ষেত্রে নতুন করে ভাবা দরকার। কোটাগুলোর স্পষ্ট ও বিস্তারিত সংজ্ঞায়ন জরুরি, যাতে কোনো অনিয়মের সুযোগ না থাকে। বাংলাদেশে একটা সার্টিফিকেট জোগাড় করা অসম্ভব কিছু নয়। ন্যূনতম পাস নম্বর ছাড়া কোনো শিক্ষার্থীকে কোটার সুবিধা দেওয়া ঠিক হবে না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডিনস কমিটিতে কোটার বিষয়ে জোরালো আলোচনা হয়েছে। সর্বশেষ ভর্তি কমিটির সভায় এ নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। বেশিরভাগই মত দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নাতিদের না রাখতে। শুধু সন্তানদের জন্য হলে সেটি ১ শতাংশই যথেষ্ট। আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, অনেক নাতি জানেই না তাদের দাদা কিংবা নানা কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভাবছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা, পোষ্য কোটাসহ সব কোটার বিষয়ে আমরা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। আমরা একটা কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ কমিটির মতামতের ভিত্তিতে আমরা কোটার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।’
Leave a Reply